একটি সাম্প্রতিক ঘটনা হলুদ প্রেমীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা বহন করে আনলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নারী গুরুতর লিভারের ক্ষতি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসকরা কারণ খুঁজে বের করলেন: তার নিয়মিত খাওয়া হলুদের সাপ্লিমেন্ট বা খাদ্য। হলুদ, বিশেষ করে এর সক্রিয় যৌগ কারকিউমিন, তার প্রদাহ-বিরোধী গুণের জন্য বিখ্যাত এবং আমাদের মতো অনেক রান্নার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, এই ঘটনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যকে তুলে ধরে: খাবারে থাকা হলুদ বনাম সাপ্লিমেন্ট হিসেবে নেওয়া হলুদ।
কী ঘটেছিল?
ওই নারীটি প্রতিদিন হলুদের ক্যাপসুল সেবন করতেন, সম্ভবত এমন উচ্চ মাত্রায় যা রান্নায় ব্যবহৃত হলুদের পরিমাণের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। সময়ের সাথে সাথে, এই উচ্চ মাত্রার সাপ্লিমেন্ট সেবনের ফলে তার ওষুধ-প্ররোচিত লিভারের ক্ষতি (Drug-Induced Liver Injury) হয়, যার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে, সাপ্লিমেন্ট বন্ধ করার পর তার লিভার ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।
সাপ্লিমেন্টে বিপদ কেন?
1.অত্যধিক ঘনীভূত মাত্রা: সাপ্লিমেন্টগুলো খাবারে পাওয়া পরিমাণের চেয়ে বহুগুণ বেশি পরিমাণে কারকিউমিন সরবরাহ করে। আপনার লিভারের পক্ষে এই অতিরিক্ত বোঝা প্রক্রিয়া করা কঠিন হয়ে পড়ে।
2.নির্দিষ্ট ফর্মুলেশন: অনেক সাপ্লিমেন্ট কারকিউমিনের শোষণ বাড়ানোর জন্য পিপারিন (গোলমরিচের নির্যাস) এর মতো সংযোজন পদার্থ যোগ করে। যদিও এটি কার্যকর, এটি লিভারের বিষাক্ততার (টক্সিসিটি) ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে।
3. শুদ্ধতা ও দূষণকারী পদার্থ: সাপ্লিমেন্ট ওষুধের মতো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়। কিছু পণ্যে দূষণকারী পদার্থ বা অঘোষিত উপাদান থাকার ঝুঁকি থাকে, যা ক্ষতিকর হতে পারে।
4. ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা: কিছু মানুষ নির্দিষ্ট যৌগের (যেমন উচ্চ মাত্রার কারকিউমিন) প্রতি লিভারের ক্ষতির দিক থেকে সহজাতভাবেই বেশি সংবেদনশীল।
খাবারে হলুদ (সাধারণত) নিরাপদ কেন?
আপনার তরকারি, ডাল বা সবজি খাবারে যে হলুদ ব্যবহার করেন, সেটাই সমস্যা নয়। কারণ হল:
প্রাকৃতিকভাবে কম মাত্রা: রান্নায় ব্যবহৃত হলুদ গুঁড়োতে কারকিউমিনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে খুবই কম থাকে।
সম্পূর্ণ খাদ্য ম্যাট্রিক্সের অংশ: যখন খাবারের অংশ হিসাবে হলুদ খাওয়া হয়, তখন খাবারের অন্যান্য উপাদান ও ফাইবার প্রভাবিত করে যে এটি কীভাবে শোষিত হয় এবং বিপাক হয়।
দীর্ঘকালীন নিরাপদ ব্যবহারের ইতিহাস: ভারতীয় রান্নার মতো বিভিন্ন সংস্কৃতিতে রান্নায় হলুদের ব্যবহার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে এবং স্বাভাবিক খাদ্যতালিকাগত পরিমাণে এটি নিরাপদ বলে প্রমাণিত।
প্রধান বার্তা ও সতর্কতা:
প্রথমে খাবার: নির্ভয়ে রান্নায় প্রচুর পরিমাণে হলুদ ব্যবহার করুন! আপনার খাবারের সেই সোনালি রং একদম নিরাপদ এবং উপকারী।
সাপ্লিমেন্ট নিয়ে সতর্কতা: কখনই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া উচ্চ মাত্রার হলুদ/কারকিউমিন সাপ্লিমেন্ট শুরু করবেন না, বিশেষ করে যদি:
আপনার আগে থেকে লিভারের কোনো সমস্যা থাকে।
আপনি অন্য কোনো ওষুধ সেবন করেন (হলুদ রক্ত পাতলা করার ওষুধ, ডায়াবেটিসের ওষুধ ইত্যাদির সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে)।
লক্ষণ চিনুন: পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, ত্বক বা চোখ হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), অত্যাধিক ক্লান্তিবোধ বা প্রস্রাবের রং গাঢ় হওয়া লিভারের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন।
কোনো সাপ্লিমেন্টই ঝুঁকিমুক্ত নয়: মনে রাখবেন, শুধু হলুদ নয়, যেকোনো হার্বাল সাপ্লিমেন্টই লিভারের ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে উচ্চ মাত্রায় বা দীর্ঘদিন ধরে সেবন করলে।
সারমর্ম: হলুদ আমাদের রান্নাঘরের অমূল্য একটি উপাদান। খাবারে স্বাভাবিক পরিমাণে এটি ব্যবহার নিরাপদ ও উপকারী। কিন্তু সাপ্লিমেন্ট হিসেবে উচ্চ মাত্রায় গ্রহণ গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি, বিশেষ করে লিভারের ক্ষতির কারণ হতে পারে। সচেতন হোন, প্রাকৃতিক খাবারকেই প্রাধান্য দিন এবং যেকোনো সাপ্লিমেন্ট শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
